Ad

আওরঙ্গজেব


লেখক- তহা আলি খান, ওয়েব সম্পাদনা- সেখ মইনুল হাসান


গতকাল রাত্রে  Audrey Truschke এর একটি সাক্ষাতকার পড়েছিলাম। আমি উনার শব্দের হেরফের না করেই আর্টিকল লিখছি।

Audrey Truschke কে?



Audrey Truschke নিউ জার্সি স্থিত নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং আমেরিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্কলার। ইনি অনেক তথ্য সংগ্রহ করে ভারতের মোঘল বাদশাহদের নিয়ে অনেকগুলো পুস্তক লিখেছেন।  
তাঁর লিখিত পুস্তক  Culture of Encounters: Sanskrit at the Mughal Court বিশ্ব বিখ্যাত হয়ে সমস্ত পুরস্কার অর্জন করে নেয়। তাঁর লিখিত অন্যান্য পুস্তকের মধ্যে-
"Aurangzeb : The Life And Legacy Of  India's Most Controversial King "
Aurangzeb: The Man and the Myth 
সারা বিশ্বে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে। 
এবার 2021 সালে তাঁর নতুন পুস্তক প্রকাশিত হতে চলেছে, যে পুস্তকের জন্য সারা বিশ্ব এখন অপেক্ষা করছে। সেই পুস্তকের  নাম হলো-
The Language of History: Sanskrit Narratives of Indo-Muslim Rule
লেখিকার মূল বক্তব্য হলো- 
"ধর্মান্ধতা 21 শতাব্দীর সমস্যা, এই ধর্মান্ধতা 17 শতাব্দীর সমস্যা নয়।
আওরঙ্গজেব সেই সময়ের একেবারে ভিন্ন ধরনের শাসক ছিলেন। ক্ষমতা নিয়ে যখন পিতা শাহজাহান এবং ভাই দারাশিকোর সঙ্গে সংঘর্ষ হলো তখন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ অধিকাংশ রাজপুত রাজাগণ আওরঙ্গজেবের সমর্থন করলেন, তাঁরা বাদশাহ শাহজাহানের সঙ্গে গদ্দারী করে যুদ্ধের ময়দানে আওরঙ্গজেবকে সমর্থন করলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন জয়পুরের রাজা সভাই জয়সিংহ এবং জোধপুরের জশবন্ত সিং রাঠোর। আর যে শিবাজী সারাজীবন আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সংঘর্ষরত ছিলেন, সেই মারাঠা সেনা এবং মূখ্য মূখ্য পদে মুসলিমরা ছিলেন।"
 আওরঙ্গজেব কট্টরপন্থী শাসক ছিলেন এমনি এক প্রশ্নের উত্তরে Audrey Truschke স্পষ্টভাবে বলেন- "17 শতাব্দীতে এতো ধর্মান্ধ ছিল না, যতো ধর্মান্ধ 21 শতাব্দীতে আছে।"
"আওরঙ্গজেবকে ভারতীয় ঐতিহাসিকরা বোঝার চেষ্টা করেন না। আপনারা ইতিহাসের কোনো চরিত্রের উপরে ভালো কিংবা খারাপ হওয়ার তকমা একতরফা ভাবে কেমন করে লাগাতে পারেন? আপনাদের ভারতে সেটাই হচ্ছে। বাদশাহ আওরঙ্গজেব ভারতীয় ইতিহাসকে অন্যান্য মোঘল বাদশাহদের থেকে বেশী প্রভাবিত করেন।"
তিনি আরোও বলেন- "আমি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। আওরঙ্গজেবের বিষয়ে আমি পরে পড়েছি, জেনেছি। একবার এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সঙ্গে টানা বিতর্ক চলাকালীন আমি বাদশাহ আকবরের সম্বন্ধে তীক্ষ্ম আক্রমণ করি এবং সবার কাছে হাস্যাস্পদ প্রমাণিত হই। আমার মনে হল ঐতিহাসিকরা আওরঙ্গজেবকে বহু নিন্দনীয় পরিপ্রেক্ষে বিচার করেন। আর আওরঙ্গজেবকে ন্যায় পাইয়ে দেওয়ার কাজ আমি আমার লিখিত পুস্তকের মাধ্যমে চেষ্টা করছি।"

তবে আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক কারা বানালেন?

Audrey Truschke -এর বক্তব্য অনুযায়ী, আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সময়ে ছোট্ট খাটো দোকানদার যারা ইংরেজদের দালাল ছিলেন তাঁরা এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে যাতায়াত করতে করতে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে উপনিবেশ তৈরী করা।
উপনিবেশবাদের এই বিপদ বাদশাহ আওরঙ্গজেব বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। এর পূর্বে ভারতে ইংরেজদের প্রভাব ছিল না। তার পূর্বে ভারতে পর্তুগিজ এবং ফ্রেঞ্চরা ছিলেন। ইংরেজদের ভারতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভারতীয়দের প্রয়োজন জরুরী ছিল। তাই তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাধারী শাসক এবং শক্তিশালী শাসক আওরঙ্গজেবকে বদনাম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। ইংরেজরা এই কারনে বিশেষভাবে হিন্দু রাজা এবং হিন্দু জনগণের মধ্যে এই কাজ করা শুরু করে দিলেন।
অবশেষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উস্কানি দেওয়ার কাজে ইংরেজরা সফলতা পেয়ে গেলেন। যদিও আওরঙ্গজেব তাঁর পিতা, পিতামহ সকলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান এবং পবিত্র বাদশাহ ছিলেন।
ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে অমুসলিমদের মধ্যে প্রচার করলো আমরা তোমাদের রক্ষা করবো, এবং তোমাদের মুঘলদের রাজ্য আদায় করে দিব। 
তাদের এই বিষাক্ত প্রচার আজ 21 শতকে তার প্রতিক্রিয়া আরোও বিষাক্ত করে তুলেছে। তখন তাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে দেরী হয়নি। আওরঙ্গজেব আর মুঘলদের বিরুদ্ধে এই বিষাক্ত প্রচার শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতে এই মিথ্যা রাষ্ট্রবাদের প্রভাব পড়তে লাগলো। আর আজ এই বিষাক্ত প্রভাব আরোও শক্তিশালী হয়ে গেছে। 
Audrey Truschke -এর বক্তব্য অনুসারে ভারতে তথাকথিত দক্ষিণ পন্থী ঐতিহাসিকদের পক্ষপাতিত্ব চিন্তাভাবনা সম্পন্ন  লেখা গুলো যাতে অমান্য না করে পড়া হয় এবং মানুষকে প্রভাবিত করা যায় শুধু এই কারণেই দক্ষিণ পন্থী ঐতিহাসিকরা আছেন।
কিন্তু ইতিহাস শুধুমাত্র পড়ার জন্য নয়, যথেষ্ট চিন্তনের বিষয় রয়েছে। ইতিহাসের পঠন পাঠনের জন্য বিশেষ ট্রেনিং  -এর প্রয়োজন, বিশেষ অনুশাসনের প্রয়োজন, পাঠকের Academic চিন্তাধারার পরিপক্বতার প্রয়োজন।
ভারতে ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসকে একটি বিশেষ আকৃতি দিয়ে মানুষদের উপরে চাপিয়ে দেন। বাস্তবে তিনি ঐতিহাসিক নন। ইতিহাস তাদের কাছে ঘৃণা ছড়ানোর উদ্দেশ্য সাধনের একটি মাধ্যম।
হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকগণ ঔরঙ্গজেবকে দুচোখে দেখতে পারেন না। সোশাল মিডিয়াতেও তাঁরা উল্টো পাল্টা মন্তব্য করেন, তাঁদের কাছে ঔরঙ্গজেব তাঁদের ভাইয়ের হত্যাকারী, ঔরঙ্গজেব তাদের কাছে এমন একজন শাসক যিনি তাঁর পিতাকে কয়েদি বানিয়ে ছিলেন, যিনি শিখদের গুরু কে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, যিনি জোরজবরদস্তি ধর্ম পরিবর্তন  করিয়েছিলেন, যিনি হিন্দুদের জজিয়া করের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন, যিনি অসংখ্য মন্দির ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন।
এমন পরিস্থিতিতে আমার নিকট ইতিহাস জানার মাধ্যম আছে, যা কিছুজনের মাথায় ঢুকবে না, কারণ তারা জানেন আওরঙ্গজেবের জোরজবরদস্তি ধর্ম পরিবর্তন করাননি, না অসংখ্য মন্দির ধূলিসাৎ করেছেন। আজ যে ধর্ম আর আস্থার দোহাই দেওয়া হচ্ছে সেটা সেই সময় ছিল না। সেই সময় শত্রু রাজারাও মন্দির ভাঙ্গতেন। মন্দির ভেঙ্গে দেওয়া যেন বিজয়ের বহিঃপ্রকাশ ছিল সেই সময়। যে রাজা যে রাজ্য জয় করে নিতেন সেই রাজ্যের রাজ দরবার কব্জা করে ধর্মস্থল ভেঙ্গে ফেলতেন আর এইভাবে পূর্বের বিজিত রাজার দাম্ভিকতা চূর্ণবিচুর্ণ করে দিতেন। আওরঙ্গজেব নিজের ভাইদের হত্যা করিয়েছেন, নিজের পিতাকে কয়েদি বানিয়ে নেন - এগুলো অপ্রত্যাশিত কিছুই নয়। এটা মধ্যযুগীয় চালচলনের অংশ। আর এটা শুধুমাত্র আওরঙ্গজেব করেছেন এমনটা মোটেও নয়।
শাহজাহান আরোও বড় হত্যাকাণ্ড করেছিলেন। আওরঙ্গজেবকে কট্টরপন্থী মুসলিম বলা হয়। কিন্তু শাহজাহান, আকবর, জাহাঙ্গীরের শাসনকালের চেয়ে  আওরঙ্গজেবের  শাসনকালে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ছোট বড় পদে হিন্দুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী ছিল। কারণ তাঁর সাম্রাজ্য ছিল বিশালতম। তাঁর কট্টরতা ধার্মিক বা প্রশাসনিক স্তরে ছিল না। নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করাই তাঁর  উদ্দেশ্য  ছিল। 
রাজা রঘুনাথ আওরঙ্গজেবের আর্থিক বিষয়ের মুখিয়া ছিলেন, আওরঙ্গজেব তাঁর শাসনকালে হিন্দুদের কৌশলকে বেশী ব্যবহার করতেন। সেই যুগে কার্যকুশলতার উপরে এবং বুদ্ধিমত্তার উপরে জোর দেওয়া হতো। কার ধর্ম কি তার উপরে জোর দেওয়া হতো না।
শিবাজীর সেনাবাহিনীর বেশী সংখ্যক কমান্ডার মুসলিম ছিলেন। ধর্মান্ধতা 21 শতাব্দীর দান, 17 শতকের ভারত ধর্মান্ধ ছিল না। আজ ভারতে মুঘলদের ইতিহাসকে যেভাবে আবর্জনা করিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে সেটা হচ্ছে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের বিস্তার। 
আপনারা ইতিহাসের এতো গুরুত্বপূর্ণ অংশকে কিভাবে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারেন? আপনারা শব্দের হেরফের করে দিতে পারেন কিন্তু ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারবেন না। অতীত নিজের মূলরূপে সর্বদা থাকে আর সর্বদা থাকবেই। আপনারা নির্মীয়মান ভবিষ্যত বিগড়ে দিতে পারেন কিন্তু ভুতকাল বিগড়াতে পারবেন না।
 হিন্দুত্ববাদীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাঁরা সেই ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে আছেন যে সংস্কৃতি প্রারম্ভ থেকেই ইতিহাসের সত্যতাকে গুরুত্ব না দিয়েই পৌরাণিক যুগের মনগড়া গল্পকে চমৎকার মেনে আসছেন। তাই তাঁরা নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের পিছনে সর্বদা হাত ধুয়ে পড়ে আছেন। 
মুঘলদের সময়ের ইতিহাসকে ইংরেজরাও অপছন্দ করেন, আর হিন্দুত্ববাদীরাও অপছন্দ করেন। বর্তমানে মুসলিমদের ঘৃণা করার জন্য আওরঙ্গজেবকে তুলে এনে বলা হচ্ছে, আওরঙ্গজেবকে ঘৃণা করো। তাঁর সম্বন্ধে মনগড়া মিথ্যা কাহিনী গড়ো আর চিৎকার করে করে সবাইকে শোনাও। প্রয়োজনে রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ ফার্সি ভাষায় করে দাও। তিনি যতো মন্দির না ভেঙ্গেছেন তত মন্দিরের বাৎসরিক খরচ তাঁদের উপরে বেঁধে দাও। 
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ থেকে ভারত ছাড়া পেয়ে গেলেও তার কেমিস্ট্রি পরিবর্তন হয়নি। ইতিহাসকে কাল্পনিক করার যতো চেষ্টা করা হোক না কেন, ইতিহাস কাল্পনিক নয়। 
ভারতের সিন্ধু নদের তীরে বসবাসকারী মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমনভাবে থাকতে পারে!! তাদের পিছনে রয়েছে ত্রেতা যুগ আর দ্বাপরের মিথোলোজির  মিথ!!


Post a Comment

0 Comments