Ad

আধিপত্যবাদী ও ইসলামোফোবিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের উত্থান

লেখক- গোলাম রশিদ , ওয়েব সম্পাদনা- সেখ মইনুল হাসান

তারা সবসময় নামাযের টুপি পরে থাকে, কথায় কথায় ‘ইনশাআল্লাহ বলে কিংবা, আরবি-উর্দু শব্দ ছাড়া কথা বলতে অক্ষম। ওরা খুব ঝগড়াপ্রিয়, সবাই দাড়ি রাখে, চোখে সুরমা লাগায়, পাঞ্জাবি পরে থাকে, কোনও মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সমুদ্র খুঁজতে চেষ্টা করে না। হাঙ্গামা, খারাপ কাজ, নিষ্ঠুরতা সবই মুসলিমদের কাজ।


ফিল্মে ওরা শুধু খলনায়ক চরিত্রেই মানানসই। ওরা এত খারাপ যে, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে মানুষের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। ওরা এমনই, তাই ইতিহাসের তােয়াক্কা না করেই সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ‘পদ্মাবত’ সিনেমায় নিষ্ঠুর, নরমাংসভােজী, অসভ্যতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। কিংবা, বর্তমানে দুবাই, মুম্বইয়ের মাফিয়া ডন। মুসলিমরা ইতিহাসের আয়নায় অসভ্য, নয় নিষ্ঠুর, অত্যাচারী জানােয়ার। কিন্তু … সৌভাগ্যক্রমে ও আশ্চর্যজনকভাবে তুরস্কে নির্মিত ‘দিরিলিস আরতুগরুল’ সিরিজে মুসলিম চরিত্রগুলিকে এই স্টিরিওটাইপের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়নি। পরিচালক মেহমেত বােজদাগ তাদের অন্য ভাবে এঁকেছেন। আসলে মুসলিমরা যা, যেভাবে তাদের মন একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখতে চায়, ঠিক সেরকম ভাবেই গড়ে উঠেছে এই ধারাবাহিক চিত্রের কাহিনি।



এ বছরের প্রায় শুরু থেকেই বিশ্ব কোভিড-১৯ – এর বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই করে চলেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে জারি করা হয়েছে লকডাউন। তবুও করােনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। করােনার ঠিক বিপরীত প্রান্তে দিরিলিসের জনপ্রিয়তাও আর্তুলগালির দৌড়ের গতির মতাে (আরতুগ্রুলের ঘােড়া) বেড়েই চলেছে। ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরাই থেকে শুরু করে ( যিনি তুর্কি ‘বে’ – এর টুপি পরে ছবিও তুলেছেন ) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান কিংবা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক আরতুগ্রুলকে গ্রহণ করেছেন।


ত্রয়ােদশ শতকে ওসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে সুলতান ওসমানের পিতা আর্তুরুল বা আরতুগ্রুলের অকুতােভয় লড়াকু জীবনই কি প্রাণ সঞ্চার করেছে? ভিএফএক্স , এসএমএক্স, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয় দক্ষতা আর কাহিনির অসামান্য বুনােটই কি দর্শককে আটকে রাখছে স্মার্টফোন বা টিভির পর্দায়? নাকি অন্য কিছু, যা মুসলিম তরুণ-তরুণী, যারা বুদ্ধির পরপর শুধু ছি ছি শুনতেই অভ্যস্ত, যারা মুসলিমদের চাকর, খানসামা, বিশ্বাসঘাতক কিংবা খলনায়ক চরিত্রেই দেখে অভ্যস্ত।


এইসব তাদের মনে যে গ্লানির সৃষ্টি করেছিল, তারই কি উপশম দিচ্ছে এই আরতুগ্রুল ? সে একজন মুসলিম বীর যােদ্ধা, যে তরবারি চালিয়ে খ্রিস্টান নাইট বা দুর্ধর্ষ মােঙ্গলদের পর্যন্ত পরাস্ত করতে পারে, যে অসাধারণ মানবিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গােষ্ঠীর সংকট নিরসন করে, সেই আবার রােমান্টিকভাবে একজনকে ভালােবাসতেও পারে। যে মুসলিম তরুণ – তরুণী রােল মডেল বা নিজ সংস্কৃতির কোনও ছাপ ‘গেম অব ঘোনস ” বা অন্য কিছুতে দেখতে পাচ্ছি না , সেই আত্মমর্যাদাটুকুর চিত্রায়নই কি তাদের এটা দেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে? বিশ্বের ৬০ টির’ও বেশি দেশের কোটি কোটি মানুষ আরতুগ্রুল সিরিজ-জ্বরে আক্রান্ত।



মধ্যপ্রাচ্য,দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ছড়িয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতেও এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাশ্চাত্যের পপ কালচারকে হারিয়ে এরদোয়ানের দেশে তৈরি হওয়া টিভি সিরিজ টুকে পড়েছে সেখানেও। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্ৰী ইমরান খান আন এটি দেখার পর মুগ্ধ হয়ে সেটি উর্দুতে ডাবিং করে পিটিভিতে সম্প্রচারের নির্দেশ দেন । এবছরের ১ রমজান থেকে দিরিলিস আরতুগ্রুল উর্দুতে সম্প্রচারিত হওয়ার পর থেকে আনাতোলিয়ার ঝড় সারা বিশ্বসহ দক্ষিণ এশিয়ায়ও আছড়ে পড়েছে যেন । জনপ্রিয়তায় বিশ্বের সব সিরিজকে ছাপিয়ে গেছে আরতুগ্রুল। মুসলিম ইতিহাসকে উপজীব্য করে বেশকিছু চলচ্চিত্র ও সিরিজ (মেসেজ, মুহাম্মদ দ্য মেসেঞ্জার অব গড) থেকে শুরু করে খিলােফতে রাশিদিন (ওমর সিরিজ বেশ জনপ্রিয়), সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উপর সিরিজ রয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‘দ্য মেসেজ’ ভালোই জনশ্রিয়।


তবে দর্শকদের চাহিদার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সব সিনেমা ও সিরিজকে ছাড়িয়ে গেছে দিরিলিস আরতুগ্রুল। কারণ কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশনও খুবই উন্নতমানের, যা যে – কোনও বয়সের দর্শককে স্ক্রিনে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছে। আর এই সময়টিতে স্ক্রিনে মুসলিমদের উপস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে এনেছে।


উসমানিয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উসমানের পিতা আরতুগ্রুল গাজীর লড়াকু, সাহসী জীবন নিয়েই এই সিরিজের কাহিনি তৈরি হয়েছে পাঁচটি সিজনে। ইতিহাসে যদিও পর্যাপ্ত তথ্য নেই আরতুগ্রুলকে নিয়ে, তবু মূল ঘটনাকে অবিকৃত রেখেই এটি তৈরি হয়েছে। নেতৃত্ব-শুন্যতা মুসলিমদের মনকে যখন হতাশায় ডুবিয়ে রেখেছিল, ঠিক তখনই এশিয়া মালভূমিতে যাযাবর জীবন – যাপনকারী ছোট কায়ী গােষ্ঠীর নেতা সুলাইমান শাহ ও হাইমে হাতুনের ঘর আলো করে দ্বাদশ শতক্ষীর শেষলগ্নে জন্ম নেন আতুগ্রুল।


সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যায়িকতার মিশেল তার জীবনকে মহিমাণ্বিত করে তুলেছে। বর্তমান প্রজন্মের যুবক দেখছে সর্বত্রই মুসলিমরা চাপে পড়ে পর্যদূস্ত। করােনা ছড়ানাের ভুয়ো অভিযােখ তুলে সামাজিক ও অনলাইন জীবনে তাদের হেনস্থা করছে । তখন সেই পরিস্থিতিতে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে বসা যুবকরা নিজের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে এই কাহিনিতে। এই কাহিনিতেও কুরতুগলু , কোচাবাঁশ , নাশেরের মত স্বার্থপর , কুটিল চক্রান্তকারী মুসলিম রয়েছে , কিন্তু জয় সেই ভালাে মুসলিমদেরই । কোনওভাবেই বিকৃত করা হয়নি ঈমানদার মুসলিম চরিত্রকে।

মুসলিমরাও প্রোটাগনিস্ট হতে পারে, তা এই সিরিজ প্রমাণ করে দিয়েছে। ঐতিহাসিক এই সিরিজে আর্তুগ্রুলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুর্কি অভিনেতা এনজিন আলতান দোয়াজতান। তার অনবদ্য অভিনয়ও দিরিলিস আরতুগ্রুলের দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তার সহযােগী বামসি, তারগুত , দোয়ান চরিত্রগুলি দর্শকদের মন জয় করেছে। সমকালীন দার্শনিক ইবনে আরাবির উপস্থিতি এর অনন্য বৈশিষ্ট তুলে ধরেছে।

তুর্কি মুসলিমদের পরিচয়ের , হারানাে ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধানও এতে করা হয়েছে। মেহমেত বােজশখ অসাধারণ একটি কাজ উপহার দিয়েছেন। নারী চরিত্রগুলিকে তিনি অসাধারণ সাহসী ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন দেখিয়েছেন। বাংলা , হিন্দি সিরিয়ালেতে তারা কান্না ও কুটিল চক্রান্ত করে সময় কাটায়না । তারা প্রয়োজনে তরবারি চালাতে পারে ও গোষ্ঠী পরিচালনা করতে পারে। হাইমে মা , হালিমা সুলতানা চরিত্রগুলি এই জন্যই জনমনে জায়গা করে নিয়েছে।

কোভিড- ১৯ – এর প্রেক্ষাপটেও দেশে মুসলিম – বিরেধী প্রপাগান্ডা জারি থেকেছে । করােনা ভাইরাস ছড়ানাের ভুয়াে অপবাদ দিয়ে মুসলিম ও ইসলামকে কলুষিত করার অপচেষ্টা হয়েছে। এর ফলে নড়েচড়ে বসেছে আরব দেশগুলিও। বিশ্বজুড়ে ইসলামােফোবিয়া মােকাবিলা করতে আধুনিক প্রজন্ম আগ্রহী । তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালয়েশিয়ার তিন রাষ্ট্রপ্রধান কয়েক মাস আগে এক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পশ্চিমা টেলিভিশন ও মিডিয়ায় যেভাবে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে তারা একজোট হয়ে লড়বে। একটি আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম চ্যানেলের কথাও তারা চিন্তা করেন। আর্তুগ্রুল অনেকটা সেই প্রচেষ্টারই আগাম একটি উদাহরণ। পশ্চিমা মিডিয়া, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মুসলিমদের বরাবরই অসভ্য, সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে।

অন্যদিকে , মুসলিম দেশগুলাের চিত্রনির্মাতারাও ইতিহাস , ঐতিহ্যের উপর তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন না, তথাকথিত সেক্যুলারিজম রক্ষা করতে গিয়ে। ফলে মুসলিমরা ‘আদার’ হিসেবেই থেকে যায়। অথচ তাদেরও জীবন সংকট, আনন্দ, হাসি,কান্না রয়েছে। সেগুলাের কোনও উপস্থাপনা নেই মুলধারার মিডিয়ায় ।

আমেরিকার এ্যামি ইউশেফের ‘ র‍্যমি ’ ওয়েব সিরিজ বা আর্তুগ্রুল সেই অভাবকেই পূরণ করার চেষ্টা করছে। আমাদের সাহিত্য – সংস্কৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে তারা যেটাকে সাহিত্য মনে করছেন। তাই শুধু সাহিত্য বা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে। সেখানে মুসলিমরা কেমনভাবে উঠে আসছে, বা আদৌ থাকছে কীনা, সেই প্রশ্ন এতদিন কেউ করেনি। কিন্তু তথাকথিত মেইনস্ট্রিমের কালচারের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতি ভ্রু কুঁচকে তাকানাে শুরু হয়েছে এবার ।

আর তরুণ প্রজন্ম তার উত্তর খুঁজে পেয়েছে আর্তুগ্রুল সিরিজের মধ্যে। পাশ্চাত্য ভাবধারার বাইরে গিয়ে শালীনতা ও নৈতিক মান বজায় রেখে কোটি কোটি মানুষের মন জয় করে বিশাল আর্থিক সাফল্যও যে পাওয়া যায়, তারও প্রমাণ এই ঐতিহাসিক ড্রামা সিরিজ। ভালাে প্রোডাকশন, স্টোরিলাইন মন কাড়তে পারে দর্শকের। মুসলিমদের কাহিনি বা চরিত্র নিয়ে ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল নির্মাণ করা যায় না, এমন পূর্বধারণাকেও ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে ‘দিরিলিসি আর্তুগ্রুল ‘।(সূত্র : পূবের কলম)


Post a Comment

0 Comments