লেখক- মোকতার হোসেন মন্ডল
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ভারতীয় ইতিহাসে এক আবেগের নাম। সবাইকে নিয়ে চলার মন্ত্র তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন বলেই আজও কোটি কোটি মানুষের প্রেরণা তিনি। কিন্তু ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় ব্যাক্তিকে মুসলিমরা যেভাবে ‘নেতাজি’ হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন,তাঁদের নিয়ে আমরা খুব কম আলোচনা করি। রাষ্ট্র নেতাদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও জাতপাত ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে রক্তে রঞ্জিত স্বাধীনতার ইতিহাসে অনেকেরই নাম জায়গা পায়নি। অথচ প্রকৃত সত্য ইতিহাস একটি সুন্দর দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সুভাষ চন্দ্র যেন আজাদ হিন্দের প্রাণ ছিলেন , আর দেহটি মস্তকের মত যাকে নির্ধারণ করে ছিলেন তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত যুদ্ধবিদ মেজর আবিদ হোসেন। যাঁকে সঙ্গে করে সুভাষচন্দ্র অত্যন্ত গোপনে জার্মান সাবমেরিনে চড়ে ঘাঁটি ছাড়েন। ফাঁসির আসামির মতো রবারের ডিঙ্গিতে কিভাবে জাপানের টোকিও পৌঁছন সে এক বড় বিশ্ময়কর ইতিহাস।
সুভাষচন্দ্র বসুর আরও শুধু সহকর্মী নয়,সহযোগী বীর বিপ্লবী কমান্ডার ও মেজর নেতাদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুর রহমান ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কর্নেল শাহনওয়াজ খান। অন্যান্য বিখ্যাত বীর বিল্পবী মুসলমানদের মধ্যে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেনারেল মির্জা এনায়েত আলী বেগ। আর্মি বিভাগের কমান্ডার ছিলেন আবদুল মজিদ (এ.ডি.সি)।
এখানে একথা যেন মনে না করা হয় যে শুধু মাত্র মুসলমানরাই সর্বেসর্বা ছিলেন। আসলে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে সমস্ত দুর্লভ তথ্য চাপা পড়ে আছে সেগুলোকে যথাসম্ভব তুলে ধরা প্রতিটি সচেতন দেশপ্রেমী নাগরিকের কর্তব্য।
নেতাজিকে যিনি পূর্ণ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন মৌলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধি,ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় যাঁকে ‘ওবেদুল্লা’ বলেছেন। তিনি সুভাষ চন্দ্র বসুকে ভারতের বাইরে নানা নামে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই সুভাষ বসুর নাম দিয়েছিলেন মাওলানা জিয়াউদ্দিন। ওই বিখ্যাত বিপ্লবী মাওলানাকে (নেতাজি সুভাষকে) যখন ভারত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তখন সেই বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে তিনি জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, কাবুল প্রভৃতি স্থানে এমন কায়দায় সংগঠন করে এসেছিলেন যাতে পরবর্তীকালে প্রতিনিধি হিসেবে অন্যের যাওয়া সহজ হয়। তাছাড়া প্রত্যেকটি জায়গায় শিষ্য ও বন্ধু সৃষ্টি করে ভারতের স্বাধীনতার সাহায্য-সোপান সৃষ্টি করে এসেছিলেন। সেখানে যাঁদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন এবং যাঁদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন তাঁরা বেশিরভাগই ছিলেন রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মী। সুভাষ বসু ওরফে মাওলানা জিয়াউদ্দীন নামক বাঙালিকে ইতিহাসে যদিও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্থান দেওয়ানো হয়েছে কিন্তু সুভাষের নেতা অর্থাৎ নেতাজির নেতা মাওলানা ওবায়দুল্লাকে আমাদের বর্তমান ও ভাবী সন্তানরা যে কী করে চিনবে তার কোনো উপায় রাখা হয়নি। সেই লুকিয়ে রাখা ইতিহাসকে দেশের একশো তিরিশ কোটি জনতার সামনে তুলে আনা শুধু ইতিহাস গবেষকদের কাজ নয়, এই দায়িত্ব প্রতিটি শিক্ষিত নাগরিকের।
এ প্রসঙ্গে স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মাওলানা জহীরুল হক কে (দ্বীনপুর) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই সেপ্টেম্বর উর্দুতে যে চিঠি দিল্লি থেকে লিখেছিলেন, যেটা বন্ধুবর মাওলানা আব্দুল কাদের সাহেব কর্তৃক অনূদিত মাওলানা মুহাম্মদ তাহের সাহেব সম্পাদিত ‘ইনসানিয়াত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেটা উদ্ধৃত করছি –
“স্নেহের মাওলানা জহীরুল হক-আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমা-তুল্লাহ। আজাদী উপলক্ষে আপনার প্রেরিত পত্রের জন্য সুভেচ্ছা জানাই। পত্র পড়ে স্মৃতি পটে ভাসে শুধু মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির স্মৃতি। সে ঘটনা অনেক লম্বা,সংক্ষেপে করলেও যথেষ্ঠ সময়ের প্রয়োজন। ১৮১৪ সালের বিশ্বযুদ্ধের সময় শাহ ওলিউল্লাহর(রঃ) কাফেলার নেতা হজরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান(রঃ) অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে কাবুল প্রেরণ করেন। সেখানে মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ করেন। তন্মধ্যে জার্মানী,ফ্রান্স ও জাপানের এমন সব কর্মী নেতা সেখানে ছিলেন যাঁরা পরবর্তী কালে শাসন ক্ষমতার উচ্চপদে অধিষ্টিত হয়েছিলেন।…
২৫ বছর নির্বাসন দন্ড ভোগ করে ১৯৩৯ সনে তিনি যখন এখানে আসেন তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তিনি তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা কংগ্রেসের কাছে পেশ করে সর্বভারতীয় সংগ্ৰামের প্রোগ্রাম রচনা করেন। সেই সময় গান্ধীজী পর্যন্ত ওই পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন, তাহলেও ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনটুকু অনুমোদন লাভ করে। একদিন চায়ের মজলিসে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তাঁর চোখ ও চেহারায় চিন্তার চিহ্ন দেখে আমার মনে অনুসন্ধিৎসুর প্রশ্ন জাগে। আমি প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তরে জানালেন, ‘আমার ইচ্ছা সুভাষ ভারতের বাইরে যাক।’ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তিনি তাঁর বাসা উখলায় ফিরে যান..…..
দ্বিতীয় দফায় উখলা হতে দিল্লি পর্যন্ত আট মাইল সড়কের কোনো একটি জনমানবশূন্য স্থানে তাঁর সঙ্গে সুভাষের সাক্ষাৎ হয়। তার পরের সাক্ষাৎটি হয়েছিল কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকায়। সেখানেই তিনি সুভাষ চন্দ্র কে জাপান যাত্রার জন্য রওনা করেন। জাপান সরকারের নামে অন্তবর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে তিনি একটি ব্যক্তিগত বিশেষ বার্তা পাঠান। তাই সুভাষ সেখানে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে জাপান সরকারের সৈন্য বিভাগও তাঁর প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পেরেছিল।…….শেষ পর্যন্ত ভয়ংকর বিষ প্রয়োগে মাওলানা সাহেবের জীবন শেষ করা হয়।……
১৯৪৫ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর পুরো এক বৎসর নয় দিন পর সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়–মাওলানা সাহেব নিহত হয়েছেন। বাস্তবিক এমন-ই একজন বিপ্লবীকে ওজনের তুলদণ্ডে এক পাল্লায় রেখে অন্য পাল্লায় সারা পৃথিবী চাপালেও এই বিপ্লবীর সমান হয় না।……..আপনার সম্মানীয়া মাতার প্রতি রইল আন্তরিক সালাম। ইতি–আবুল (আজাদ)।”
নেতাজির গুরু মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধীকে নিয়ে আবুল কালাম আজাদের এই চিঠি ঐতিহাসিক গোলাম আহমেদ মোর্তুজার ‘চেপে রাখা ইতিহাস’ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে।
অনেক নেতার নেতা মাওলানা উবায়দুল্লার কোনোও মূল্যায়ন আজও হয়নি,মূল্যায়ন হয়নি সেই মাওলানা মাহমুদুল হাসানেরও,যিনি ছিলেন উবায়দুল্লা সাহেবের রাজনৈতিক গুরু।
মুহাম্মদ হাবিব। জীবনে অর্জিত সমস্ত সম্পদ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে তিনি দান করেছিলেন। সংসারের সুখ ছেড়ে দেশের মুক্তির জন্য আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেন।
রাজা হাবিবুর রহমান খান ছিলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রধান সহযোগী। সিঙ্গাপুরে তিনি নেতাজির সাথী ছিলেন। জম্মু ও কাশ্মীরের ভিমবার জেলার পাঞ্জেরী গ্রামের এই বীর বিপ্লবী ছাত্র জীবন থেকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে সুসংগঠিত ও নেতৃত্বের আনুগত্য পরায়ণ করে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।
উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনপাত করেছেন। কিন্তু প্রচারের আলোর বাইরে থেকেই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১১৬ বছর বয়সে চির বিদায় নিয়েছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের গাড়ির চালক তথা ছায়াসঙ্গী কর্নেল নিজামুদ্দিন।
তিনি নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজে কর্নেল পদে মিত্র শক্তির সঙ্গে লড়াই করেন।
উত্তরপ্রদেশে ১৯০১ সালে জন্ম হয় নিজামুদ্দিনের। তিনি নেতাজির বিশ্বস্তদের মধ্যে একজন ছিলেন বলে জানা যায়। নেতাজির আদর্শকে শিরোধার্য করেই জীবন কাটিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য কোনও কিছু করতে পিছপা হননি।
কখনও নেতাজির গাড়ির চালক হয়েছেন, তো কখনও প্রয়োজনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিলেন, অথচ ইতিহাসে যাঁদের কথা তেমন করে লেখা থাকে না, তিনিও তাঁদের মধ্যে একজন।
নিজামুদ্দিন ১৯৪২ সালে আজামগড় থেকে পালিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যান ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তারপর তিনি নেতাজির অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে বারাণসীতে ভোটের প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজামুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন ও তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন। নেতাজির মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত। তবে কর্নেলের মতো কয়েকজনের স্মৃতিতে অমলিন ছিলেন তিনি। সদা জাগ্রত ছিল নেতাজির আদর্শ। যা তিনি বরাবর ছড়িয়ে দিয়েছেন তার উত্তরসূরিদের মধ্যেও।
এটা ইতিহাসের এক বিস্ময়কর পরিহাস যে, দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিলেন তাঁদের ইতিহাস সবাইকে জানার সুযোগ আজও করে দেয়নি রাষ্ট্র! এটা কি রক্তার্জিত স্বাধীনতার সাথে বেইমানি করা নয়? কেন বিপ্লবীদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ে ইতিহাসে জায়গা দেওয়া হবে? আধুনিক ভারত কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে এর জবাব চাইছে।
0 Comments